প্রিয় বন্ধুরা, আমাদের আজকের আর্টিকেল নৈতিকতা কি এবং নৈতিকতার বৈশিষ্ট্য তে তোমাদের জানাই সুস্বাগতম। নৈতিকতা শব্দটির ইংরেজি প্রতিশব্দ হলো Morality. বাংলায় নৈতিকতা বলতে এক কথায় বোঝায় ভদ্রতা, চরিত্র, উত্তম আচরণ ইত্যাদি।
নৈতিকতা হলো এমন একটি মূল্যবোধ যা সাধারণত উদ্দেশ্য,সিদ্ধান্ত এবং কর্মের মধ্যকার ভালো এবং খারাপ পার্থক্যগুলোকে চিহ্নিত করতে শেখায়। সহজ ভাষায়, নৈতিকতা হলো একটি মানদন্ড। নৈতিকতা কখনো কখনো পরিবার থেকে আসে, আবার কখনো বা আদর্শ, ধর্ম বা সংস্কৃতি থেকেও আসতে পারে। তবে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে নৈতিকতা আসে পারিবারিক শিক্ষা “সঠিকতা” এবং “ন্যায্যতা” সম্পর্কে যে জ্ঞান দেওয়া হয় তার ভিত্তিতে।
নৈতিকতা এমন একটি মূল্যবোধের মানদন্ড যা সমগ্র বিশ্বের জন্য কল্যাণকর। তাহলে আর দেরি কেন, চলো বন্ধুরা জেনে নেই নৈতিকতা কাকে বলে এবং নৈতিকতার বৈশিষ্ট্য গুলো কি কি।
নৈতিকতা কাকে বলে

নৈতিকতা বলতে বোঝে মানুষের আচার-আচরণ এবং কার্যক্রমের সঠিক মানদণ্ড। নৈতিকতা সমাজের রীতিনীতি, মূল্যবোধ এবং আদর্শের উপর ভিত্তি করে গঠিত। নৈতিকতা আমাদের শেখায় কোনটা সঠিক আর কোনটা ভুল, কোনটা করা উচিত আর কোনটা অনুচিত।
তবে আধুনিক নৈতিকতার বিকাশ সামাজিক এবং সংস্কৃতিক বিবর্তনের মাধ্যমে জড়িয়ে রয়েছে। কিছু সমাজবিজ্ঞানী এবং জীববিজ্ঞানী মনে করেন নৈতিকতা হলো ব্যক্তি পর্যায়ে এবং সমষ্টিগত পর্যায়ে কাজ করা ক্রমবিকাশমূলক ক্রিয়ার ফলস্বরূপ।
মনে করা হয়, নৈতিকতা শব্দটির প্রথম উদঘাটন হয়েছিল বেঁচে থাক বাবা দুজনের সহায়ক ভূমিকার কারণে। নৈতিকতার কারণে মূলত মানুষের সমবেদনা বা অপরাধবোধের বিকাশ ঘটে। নৈতিকতার বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ দিক রয়েছে। নিচে সেগুলো সম্পর্কে আলোচনা করা হলো: সততা, ন্যায়প্রণয়তা, কর্তব্যতা ইত্যাদি।
নৈতিকতার উদাহরণ
নৈতিকতার বেশ কিছু উদাহরণ রয়েছে। নিম্নে নৈতিকতার উদাহরণ গুলো দেওয়া হলো:
- সততা: সর্বদা সত্য কথা বলা এবং নিজেকে কত রাখার সর্বোচ্চ চেষ্টা করা।
- ন্যায়পরায়ণতা: পরিস্থিতি যেমনই হোক না কেন কারো পক্ষপাতিত্ব না করা। অর্থাৎ সব সময় সকলের সাথে ন্যায্য আচরণ করা।
- সহানুভূতিশীলতা: অন্যের দুঃখ-কষ্ট নিয়ে হাসি-ঠাট্টা না করা। বরং তাদের প্রতি সহায় হাওয়া।
- পরোপকারিতা: বিপদে-আপদে নিঃস্বার্থভাবে অন্যের উপকারিতা করা।
- দায়িত্বশীলতা: সঠিকভাবে নিজ দায়িত্ব পালন করা।
- সচেতনতা: পরিবেশ ও পরিস্থিতির প্রতি সচেতন হওয়া। এবং অন্যকে সচেতন করা।
- শ্রদ্ধা ও স্নেহ করা: বড়দেরকে সম্মান বা শ্রদ্ধা করা। এবং ছোটদেরকে স্নেহ করা।
- ধৈর্যশীল হওয়া: যত কঠিন পরিস্থিতিই হোক না কেন শান্ত রাখা। এবং ভালো কিছুর জন্য অপেক্ষা করা।
- ক্ষমাশীল হওয়া: কেউ ভুল বা অন্যায় করলে প্রতিশোধ না নিয়ে তাকে ক্ষমা করা।
- কৃতজ্ঞতা: কেউ উপকার করলে তার প্রতি কৃতজ্ঞ হওয়া। এবং তার অবদানকে স্বীকার করা।
উক্ত আলোচিত গুন গুলো যদি কারো মাঝে থাকে, তাহলে সে একজন নৈতিক ব্যক্তি।
নৈতিকতার বৈশিষ্ট্য গুলো কি কি

নৈতিকতার বিভিন্ন বৈশিষ্ট্য রয়েছে। নিচে এর গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে আলোচনা করা হলো:
১. সর্বজনীনতা
নৈতিকতা সমাজের সকল সদস্যের জন্য প্রযোজ্য এবং সমানভাবে গুরুত্বপূর্ণ। এটি কোনও ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর উপর ভিত্তি করে পরিবর্তিত হয় না। নৈতিকতার নিয়ম কানুন এবং মূল্যবোধ সকল মানুষ এবং সমাজের জন্য প্রযোজ্য। জাতি, ধর্ম, বর্ণ, নির্বিশেষে নৈতিকতার মানদন্ডের কোন পার্থক্য হয় না।
তাছাড়া সার্বজনীনতা নৈতিকতার একটি মৌলিক ভিত্তি। সমাজের সকল সদস্যের জন্য মৌলিক অধিকার এবং সুযোগের নিশ্চয়তা প্রদান করে সর্বজনীনতা। সর্বজনীনতার মাধ্যমে আমরা শিখতে পারি, একে অপরের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হতে হবে এবং ন্যায় সঙ্গত আচরণ করতে হবে।
২. নিরপেক্ষতা
নৈতিকতা ব্যক্তিগত পক্ষপাতিত্ব বা স্বার্থ দ্বারা প্রভাবিত নয়। এটি ন্যায়সঙ্গত এবং সবার জন্য সমান সুযোগের পক্ষে কাজ করে থাকে। নিরপেক্ষতার মাধ্যমে মানুষ সঠিক ও ভুল নির্ণয় করতে শেখে এবং কোন তথ্য বা ঘটনাকে বিকৃত না করে সঠিকভাবে উপস্থাপন করতে শেখে। নিরপেক্ষতার ফলে সকল সিদ্ধান্ত গ্রহণের প্রক্রিয়া সবার জন্য উন্মুখ হয় এবং প্রকাশ্যে চলে আসে।
৩. মানবতাবোধ
নৈতিকতা মানুষের প্রতি সহানুভূতি, শ্রদ্ধার ভিত্তি করে গঠিত। এটি মানুষকে একে অপরের প্রতি যত্নবান হতে উৎসাহিত করে। মানবতাবোধ মানুষের মর্যাদা, মূল্য এবং গুরুত্বের উপর জোর দিয়ে প্রতিষ্ঠিত হয়ে থাকে।
তাছাড়া মানবতা বোধের মাধ্যমে মানুষ একে অপরের প্রতি যত্নশীল হয় এবং একে অপরের কষ্ট ও দুঃখ অনুভব করতে পারে। মানবতাবোধ সমাজ থেকে দারিদ্র, নিপীড়ন দূর করে। শিক্ষা, সংস্কৃতি এবং শিল্পের মাধ্যমে মানুষের জীবন মান উন্নয়নের সাহায্য করে মানবতাবোধ।
৪. যুক্তিসঙ্গতা
নৈতিকতা যুক্তির উপর প্রতিষ্ঠিত। এটি আবেগ বা অন্ধবিশ্বাসের উপর ভিত্তি করে নয়। নৈতিক সিদ্ধান্তগুলি সাধারণত যুক্তি এবং বিবেচনার মাধ্যমে নেওয়া হয়।
৫. স্থায়ীত্ব
নৈতিকতার মানগুলি সময়ের সাথে সাথে পরিবর্তিত হয় না। এগুলি সমাজের মৌলিক মূল্যবোধের উপর ভিত্তি করে গঠিত এবং দীর্ঘস্থায়ী হয়।
৬. অবশ্যম্ভাবী
নৈতিক নিয়মগুলি বাধ্যতামূলক। এগুলি অমান্য করলে সমাজে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হতে পারে। তাই নৈতিকতা সমাজের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি দিক।
৭. কল্যাণমুখী
নৈতিকতার লক্ষ্য হল সমাজের সামগ্রিক কল্যাণ সাধন করা। নৈতিকতা সর্বদা ব্যক্তি এবং সমাজের উন্নতির জন্য কাজ করে। নৈতিকতা কখনো সমাজের জন্য অকল্যাণকর কিছু বয়ে আনতে পারে না।
৮. স্বতঃস্ফূর্ততা
নৈতিক কাজগুলি সাধারণত স্বতঃস্ফূর্তভাবে করা হয়। এগুলি কোনও বাহ্যিক চাপের কারণে করা হয় না। নৈতিকতার দিকগুলো সাধারণত মানুষ নিজ ব্যক্তিত্ব থেকেই ধারণ করে এবং সে অনুযায়ী কাজ করে।
৯. নৈতিক দ্বন্দ্ব
শুধুমাত্র অনৈতিকতার মধ্যেই নয় বরং নৈতিকতার মধ্যেও প্রায়শই বিভিন্ন মূল্যবোধের মধ্যে দ্বন্দ্ব দেখা যায়। এই দ্বন্দ্বগুলি সমাধান করার জন্য যুক্তি এবং বিবেচনার প্রয়োজন।
১০. নৈতিক শিক্ষা
নৈতিকতা শিক্ষা এবং অভিজ্ঞতার মাধ্যমে অর্জন করা যায়। পরিবার, বিদ্যালয় এবং সমাজ প্রত্যেকটি ব্যক্তির নৈতিক বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
নৈতিক মূল্যবোধের গুরুত্ব

পরিবারের জন্য, সমাজের জন্য সর্বোপরি দেশের জন্য নৈতিক মূল্যবোধের গুরুত্ব অপরিসীম। নিচে নৈতিক মূল্যবোধের কিছু গুরুত্ব তুলে ধরা হলো:
- একটি সুস্থ ও স্থিতিশীল সমাজ গঠনে নৈতিক মূল্যবোধ অপরিহার্য।
- নৈতিক মূল্যবোধের অভাবে সমাজে বিশৃঙ্খলা ও অরাজকতা দেখা দিতে পারে।
- পরিবার বা সমাজের সদস্যদের মধ্যে সহযোগিতা, সহমর্মিতা ও শ্রদ্ধাবোধ তৈরি করে নৈতিক মূল্যবোধ।
- নৈতিক মূল্যবোধ মানুষকে সৎ, ন্যায়পরায়ণ ও দায়িত্বশীল হতে সাহায্য করে।
- নৈতিক মূল্যবোধের কারণে মানুষ আত্মসম্মান ও মর্যাদাবোধ নিয়ে জীবনযাপন করতে পারে।
- নৈতিক মূল্যবোধ একজন ব্যক্তির চরিত্র গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
পরিবার হলো নৈতিক মূল্যবোধের প্রথম শিক্ষা কেন্দ্র। প্রত্যেকটি সন্তান প্রথমত পরিবার থেকেই নৈতিকতার শিক্ষা পায়। এক্ষেত্রে বাবা-মায়ের উচিত তাদের সন্তানদের ছোটবেলা থেকেই নৈতিক শিক্ষা দেওয়া। এছাড়া শিক্ষার্থীদের মাঝে নৈতিক মূল্যবোধ ছড়িয়ে দেওয়ার জন্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে নৈতিক শিক্ষার ব্যবস্থা করা উচিত।
সমাজের সর্বস্তরের শিশুর মধ্যে নৈতিক মূল্যবোধ ছড়িয়ে দেওয়ার জন্য সমাজের বিশিষ্ট ব্যক্তি ও গণমাধ্যম নৈতিক মূল্যবোধের গুরুত্ব সম্পর্কে জনসচেতনতা তৈরি করতে পারে। সর্বোপরি, নৈতিক মূল্যবোধ একটি সমাজের অমূল্য সম্পদ। এর গুরুত্ব উপলব্ধি করে আমাদের উচিত একে রক্ষা ও লালন করা।
নৈতিক গুণ কি কি

নৈতিক গুণ বলতে বোঝায় যা সমাজের চোখে একজন ব্যক্তিকে সৎ ব্যক্তি হিসেবে চিহ্নিত করতে শেখায়। একজন ব্যক্তির নিম্নলিখিত নৈতিক গুণ থাকতে পারে। সেগুলো হল:
- শ্রদ্ধা,
- বিশ্বস্ততা,
- কৃতজ্ঞতা,
- আত্মনিয়ন্ত্রণ,
- ধৈর্য,
- ক্ষমাশীলতা,
- সহানুভূতি,
- দায়িত্ববোধ,
- ন্যায়পরায়ণতা,
- সততা।
একজন মানুষের ভেতর নৈতিক গুণ ভালো কে ভালো এবং মন্দকে মন্দ বলতে শেখায়। নৈতিক মূল্যবোধের কারণে মানুষ ভালো খারাপ যাচাই করতে শেখে। মানুষের সহজ জাত প্রবৃত্তি হলো নৈতিক গুণ। নৈতিকতা ব্যতীত মানুষ পশুর সমান। নৈতিকতা প্রত্যেকটি মানুষের ভেতরে থাকা একান্ত কাম্য।
নৈতিকতা সম্পর্কিত কিছু প্রশ্নউত্তর
নৈতিকতার প্রধান উৎস কি?
নৈতিকতার প্রধান উৎস হলো সমাজের প্রথা, আদর্শ ধর্ম ও ন্যায়বোধ।
নৈতিক মানদন্ডের চারটি বৈশিষ্ট্য কি কি?
নৈতিক মানদন্ডের চারটি বৈশিষ্ট্য হলো: ন্যায্যতা, পরোপকার, বিশ্বাস এবং সহযোগিতা। দৈনন্দিন সামাজিক মিথস্ক্রিয়া গঠনে নৈতিকতার মানদন্ড গঠিত হয়।
ইথিকস বা নৈতিকতা কি?
সমাজের একজন দায়িত্বশীল ব্যক্তি হিসেবে কোনটি করা উচিত এবং কোনটি করা উচিত নয়, এ সম্পর্কে বিস্তারিত জ্ঞান হলো নৈতিকতা।
নৈতিকতা শব্দের অর্থ কি?
নৈতিকতা বা মরালিটির অর্থ হলো: ভালো-মন্দ, ন্যায়-অন্যায় বোধ থাকা এবং সেই অনুযায়ী আচরণ করা।
নৈতিকতা সম্পর্কে আমাদের মতামত
নৈতিক মূল্যবোধ সম্পন্ন ব্যক্তি পরিবারের জন্য, সমাজের জন্য সর্বোপরি দেশের জন্য মঙ্গলজনক। আজকের আর্টিকেলে আমরা নৈতিকতা কি এবং নৈতিকতার বৈশিষ্ট্য গুলো কি কি সে সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করেছি। নৈতিকতা সম্পর্কিত যদি কোন প্রশ্ন থেকে থাকে আমাদের অবশ্যই জানাবেন। সম্পূর্ণ আর্টিকেলটি পড়ে দেখার জন্য আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ। এমন তথ্যবহুল আর্টিকেল পাওয়ার জন্য আমাদের ওয়েবসাইটের সাথেই থাকুন।