রাজনৈতিক সংস্কৃতি কি? রাজনৈতিক সংস্কৃতির প্রকারভেদ

শেয়ার করুন

এই সমাজে বিভিন্ন মানুষ যা করে তাই তাদের সংস্কৃতির অংশ। একটি দেশের সামগ্রিক জীবনধারণ সম্পর্কে জানতে হলে সে দেশের সংস্কৃতি সম্পর্কে বিস্তারিত ধারণা থাকতে হয়। একটি দেশের রাজনৈতিক ব্যবস্থা সম্পর্কে সেই দেশের জনগণকে রাজনীতির প্রতি বিশ্বাস, আস্থা এবং আদর্শ জ্ঞান সম্পর্কে ধারণা লাভ করানোর জন্য রাজনৈতিক সংস্কৃতি গুরুত্বপূর্ণ। 

আরো সহজভাবে বলতে গেলে, রাজনৈতিক সংস্কৃতি হল একটি সমাজের রাজনৈতিক বিশ্বাস, মূল্যবোধ, মনোভাব এবং রীতিনীতির সমষ্টি যা তাদের রাজনৈতিক জীবনকে আকার দেয়। এটি জনগণের রাজনৈতিক প্রক্রিয়া, প্রতিষ্ঠান এবং নেতৃত্বের প্রতি দৃষ্টিভঙ্গি, সেইসাথে তাদের অধিকার ও দায়িত্ব সম্পর্কে বিভিন্ন ধারণাকে অন্তর্ভুক্ত করে। 

আজকের আর্টিকেলে রাজনৈতিক সংস্কৃতি কি, রাজনৈতিক সংস্কৃতির প্রকারভেদ ও রাজনৈতিক সংস্কৃতির উপাদান সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করবো। রাজনৈতিক সংস্কৃতি সম্পর্কে জানতে  এই আর্টিকেলটি সম্পূর্ণ পড়ুন।

রাজনৈতিক সংস্কৃতি বলতে কি বুঝায়

রাজনৈতিক সংস্কৃতি কি, রাজনৈতিক সংস্কৃতির প্রকারভেদ

রাজনৈতিক সংস্কৃতি সম্পর্কে জানতে হলে আধুনিককালে রাজনৈতিক বিশ্লেষণে রাজনৈতিক সংস্কৃতির দ্বারস্থ হতে হয়। একটি দেশের রাজনৈতিক ব্যবস্থার পূর্ণ চিত্র ফুটে ওঠে রাজনৈতিক সংস্কৃতির মাধ্যমে।

যেসব দেশের সংসদীয় শাসনব্যবস্থা রয়েছে তা কল্যাণকামী রাজনৈতিক সংস্কৃতি এবং দেশের মানুষের মৌলিক সাম্য এবং স্বাধীনতার উপর ভিত্তি করে প্রতিষ্ঠিত হয়ে থাকে। 

রাজনৈতিক সংস্কৃতির সংজ্ঞা

রাজনৈতিক সংস্কৃতি সম্পর্কে ব্যাখ্যা প্রদান করতে গিয়ে বিভিন্ন দেশের রাজনীতিবিদ বিভিন্ন ধরনের ব্যাখ্যা প্রদান করেছেন। নিম্নে কিছু রাজনৈতিক সংস্কৃতির ব্যাখ্যা তুলে ধরা হলো: 

  • অধ্যাপক ম্যাকাইভার বলেছেন: কোন একটি দেশের সমাজে বসবাসরত জনসমষ্টির মনোভাব, বিশ্বাস, দৃষ্টিভঙ্গি, অনুভূতি, ইতিহাস এবং ঐতিহ্যকে কেন্দ্র করে যে সুশৃংখল এবং তাৎপর্যপূর্ণ ব্যবস্থাপনার সৃষ্টি হয় তাকে রাজনৈতিক সংস্কৃতি বলে। রাজনৈতিক সংস্কৃতির মাধ্যমে মানুষের আচার-আচরণ নিয়ন্ত্রণ করার মূল্যবোধ এবং বিধি-বিধান সৃষ্টি হয়।
  • Verba ও Almond বলেন: রাজনৈতিক সংস্কৃতি কথাটি দ্বারা সুনির্দিষ্টভাবে কতিপয় রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি কে বোঝায়। যার দ্বারা রাজনৈতিক ব্যবস্থায় ব্যক্তি নিজের ভূমিকা সম্পর্কে সচেতন হয় এবং অন্যদেরকেও রাজনীতিক সংস্কৃতি সম্পর্কে বিশ্লেষণ করতে সমর্থ হয়।
  • David Paul বলেছেন: রাজনৈতিক সংস্কৃতি হচ্ছে মূল্যবোধ, প্রতিক, দৃষ্টিভঙ্গি এবং আচরণের পর্যবেক্ষণযোগ্য এক বহিরাকৃতির একটি বাস্তবায়িত রূপ। রাজনৈতিক সংস্কৃতি ঐতিহাসিক দৃষ্টিকোণ থেকে অবলোকন করলে মনোভাবগত উপাত্ত অপেক্ষা অধিক পরিমাণে সমাজের রাজনৈতিক সংস্কৃতির ওপর প্রভাব বিস্তার করতে সক্ষম।

রাজনৈতিক সংস্কৃতির প্রকারভেদ

রাজনৈতিক সংস্কৃতির বিভিন্ন প্রকারভেদ রয়েছে। এগুলো হলো: 

  • সংকীর্ণতাবাদী রাজনৈতিক সংস্কৃতি,
  • অধীনস্থ রাজনৈতিক সংস্কৃতি, 
  • অংশগ্রহণমূলক রাজনৈতিক সংস্কৃতি, 
  • মিশ্র রাজনৈতিক সংস্কৃতি,

সংকীর্ণতাবাদী রাজনৈতিক সংস্কৃতি (Parochial Political Culture)

রাজনৈতিক সংস্কৃতি কি, রাজনৈতিক সংস্কৃতির প্রকারভেদ

এই সংস্কৃতিতে জনগণের রাজনৈতিক সচেতনতা কম থাকে। তারা স্থানীয় বা গোষ্ঠীগত বিষয় নিয়ে বেশি আগ্রহী থাকে এবং জাতীয় বা বৃহত্তর রাজনৈতিক বিষয়ে তাদের আগ্রহ কম থাকে।

অধীনস্থ রাজনৈতিক সংস্কৃতি (Subject Political Culture)

রাজনৈতিক সংস্কৃতি কি, রাজনৈতিক সংস্কৃতির প্রকারভেদ

এই সংস্কৃতিতে জনগণ সরকারের প্রতি অনুগত থাকে এবং তাদের আদেশ ও নির্দেশ মেনে চলে। তারা রাজনৈতিক আলোচনা ও বিতর্কে কম অংশগ্রহণ করে এবং সরকারের সমালোচনা করতে দ্বিধা বোধ করে।

অংশগ্রহণমূলক রাজনৈতিক সংস্কৃতি (Participant Political Culture)

রাজনৈতিক সংস্কৃতি কি, রাজনৈতিক সংস্কৃতির প্রকারভেদ

এই সংস্কৃতিতে জনগণ রাজনৈতিকভাবে সক্রিয় থাকে এবং তারা সরকারের নীতি ও সিদ্ধান্ত গ্রহণে অংশগ্রহণ করে। তারা তাদের অধিকার সম্পর্কে সচেতন থাকে এবং সরকারের সমালোচনা করতে ভয় পায় না।

মিশ্র রাজনৈতিক সংস্কৃতি (Mixed Political Culture)

রাজনৈতিক সংস্কৃতি কি, রাজনৈতিক সংস্কৃতির প্রকারভেদ

অনেক দেশে এই ধরনের রাজনৈতিক সংস্কৃতি দেখা যায়, যেখানে বিভিন্ন ধরনের রাজনৈতিক সংস্কৃতির মিশ্রণ থাকে। কিছু লোক সক্রিয়ভাবে রাজনীতিতে অংশগ্রহণ করে, আবার কিছু লোক নিষ্ক্রিয় থাকে।

রাজনৈতিক সংস্কৃতির প্রকারভেদ একটি দেশের রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা, গণতন্ত্রের বিকাশ এবং নাগরিক সমাজের প্রকৃতি নির্ধারণ করে, যা প্রত্যেকটি সমাজের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

রাজনৈতিক সংস্কৃতির উপাদান

রাজনৈতিক সংস্কৃতি কি, রাজনৈতিক সংস্কৃতির প্রকারভেদ

রাজনৈতিক সংস্কৃতি হলো একটি সমাজের মানুষের রাজনৈতিক বিশ্বাস, মূল্যবোধ, মনোভাব এবং রীতিনীতির সমষ্টি। এটি একটি দেশের রাজনৈতিক জীবনের ভিত্তি তৈরি করে এবং গণতন্ত্রের সফলতার জন্য এর উপাদানগুলো জানা খুবই জরুরি। নিচে রাজনৈতিক সংস্কৃতির কিছু গুরুত্বপূর্ণ উপাদান আলোচনা করা হলো:

রাজনৈতিক বিশ্বাস ও মূল্যবোধ:

রাজনৈতিক বিশ্বাস এবং মূল্যবোধকে তিনটি ভাগে ভাগ করা যায়। যথা: 

  • গণতন্ত্রের প্রতি বিশ্বাস, 
  • নাগরিক অধিকারের প্রতি সচেতনতা, 
  • সহনশীলতা।

গণতন্ত্রের প্রতি বিশ্বাস

জনগণের মধ্যে গণতন্ত্রের আদর্শের প্রতি বিশ্বাস থাকতে হবে। অর্থাৎ, তারা নির্বাচন, ভোটাধিকার এবং আইনের শাসনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হবে।

নাগরিক অধিকারের প্রতি সচেতনতা

নাগরিকদের তাদের মৌলিক অধিকার সম্পর্কে জানতে হবে এবং সেগুলো ভোগ করার জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে।

সহনশীলতা

বিভিন্ন রাজনৈতিক মতাদর্শের প্রতি সহনশীল হতে হবে এবং অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে হবে।

রাজনৈতিক মনোভাব

রাজনৈতিক মনোভাবকেও তিনটি ভাগে ভাগ করা যায়। যথা: 

  • রাজনৈতিক অংশগ্রহণ, 
  • সরকারের প্রতি আস্থা, 
  • দায়িত্ববোধ। 

রাজনৈতিক অংশগ্রহণ

নাগরিকদের রাজনৈতিক প্রক্রিয়া যেমন – নির্বাচন, আলোচনা ও বিতর্কে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করতে হবে।

সরকারের প্রতি আস্থা

জনগণের সরকারের প্রতি আস্থা থাকতে হবে। তবে, অন্ধভাবে নয়, সমালোচনামূলকভাবে সরকারের কাজকর্মের মূল্যায়ন করতে হবে। সরকারের প্রতি আস্থা রাজনৈতিক মনোভাবের অন্যতম অঙ্গ।

দায়িত্ববোধ

নাগরিকদের দেশের প্রতি দায়িত্ববোধ থাকতে হবে এবং সমাজের উন্নয়নে অবদান রাখতে হবে। যে দেশের নাগরিকদের দেশের প্রতি দায়িত্ববোধ নেই সে দেশ কখনো উন্নতি চরম শেখরে পৌঁছাতে পারেন।

রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান

রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানকে তিনটি ভাগে ভাগ করা যায়। সেগুলো হলো: 

  • শক্তিশালী রাজনৈতিক দল, 
  • স্বাধীন গণমাধ্যম, 
  • নিরপেক্ষ বিচার ব্যবস্থা, 

শক্তিশালী রাজনৈতিক দল

গণতন্ত্রের জন্য শক্তিশালী রাজনৈতিক দল অপরিহার্য। দলগুলো জনগণের বিভিন্ন মতামতকে প্রতিনিধিত্ব করে এবং সরকারের নীতি নির্ধারণে ভূমিকা রাখে।

স্বাধীন গণমাধ্যম

গণমাধ্যমকে স্বাধীনভাবে সংবাদ প্রকাশ করতে দিতে হবে, যাতে জনগণ সরকারের কাজকর্ম সম্পর্কে জানতে পারে এবং নিজেদের মতামত জানাতে পারে।

নিরপেক্ষ বিচার ব্যবস্থা

বিচার ব্যবস্থা স্বাধীন এবং নিরপেক্ষ হতে হবে, যাতে সবাই আইনের চোখে সমান হয়। নিরপেক্ষ বিচার ব্যবস্থা একটি দেশের সুশৃংখলতা বজায় রাখতে সাহায্য করে।

রাজনৈতিক আচরণ

রাজনৈতিক আচরণকেও তিনটি ভাগে ভাগ করা যেতে পারে। সেগুলো হলো: 

  • নিয়মতান্ত্রিক আচরণ, 
  • আলোচনা ও বিতর্কে অংশগ্রহণ, 
  • সহিংসতা পরিহার। 

নিয়মতান্ত্রিক আচরণ

নাগরিকদের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে নিয়মতান্ত্রিক হতে হবে এবং আইন মেনে চলতে হবে। নাগরিকগণ যদি রাজনৈতিক কর্মকান্ডে অংশগ্রহণ না করে তাহলে সে দেশের রাজনীতি স্বৈরাচারে পরিণত হয়।

আলোচনা ও বিতর্কে অংশগ্রহণ

রাজনৈতিক বিষয়ে আলোচনা ও বিতর্কে যুক্ত হতে হবে এবং যুক্তি ও যুক্তির মাধ্যমে নিজেদের মতামত প্রকাশ করতে হবে।

সহিংসতা পরিহার

রাজনৈতিক উদ্দেশ্য সাধনের জন্য কোনো ধরনের সহিংসতা বা ধ্বংসাত্মক কার্যকলাপ করা উচিত নয়। যা একটি সহজ সরল রাজনৈতিক আচরণের মাধ্যমে ফুটে ওঠে। সত্যিকার অর্থে যারা দেশকে ভালবেসে রাজনীতি করতে চাই তারা কখনো কোন ধরনের সহিংসতার মধ্যে নিজেকে জড়াতে পারে না।

একটি দেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতি শক্তিশালী করতে হলে এই উপাদানগুলোর প্রতি নজর রাখতে হবে। নাগরিকদের সচেতনতা, অংশগ্রহণ এবং সহনশীলতাই গণতন্ত্রকে সফল করতে পারে।

রাজনৈতিক সংস্কৃতি সম্পর্কিত কিছু প্রশ্নউত্তর

১)রাজনৈতিক সংস্কৃতি পদ্ধতি কি?

উঃ রাজনৈতিক ব্যবস্থা একটি নির্দিষ্ট রাজনৈতিক সংস্কৃতির মধ্যে এমবেড করা হয় যারা রাজনৈতিক সংস্কৃতির পদ্ধতি।

২)রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে ওরিয়েন্টেশন কি?

উঃ রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে ওরিয়েন্টেশন বলতে বোঝায় রাজনৈতিক ব্যবস্থা এবং এর বিভিন্ন অংশের প্রতি এবং ভূমিকার প্রতি দৃষ্টিভঙ্গি।

৩)রাজনৈতিক সমাজবিজ্ঞান বলতে কি বোঝায়?

উঃ ক্ষমতার সামাজিক সংগঠনের অধ্যয়ন কে রাজনৈতিক সমাজবিজ্ঞান বলা হয়।

📌 আরো পড়ুন 👇

রাজনৈতিক সংস্কৃতি সম্পর্কে আমাদের মতামত

একটি দেশের রাজনৈতিক ভূখণ্ডে সে দেশের জনগণের রাজনীতির প্রতি আশা-আকাঙ্ক্ষা থাকবে এটাই স্বাভাবিক। নিজ দেশের রাজনীতি সম্পর্কে যথেষ্ট জ্ঞান রাজনৈতিক সংস্কৃতের অংশ। আজকের আইটে গেলে আমরা রাজনৈতিক সংস্কৃতি সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করেছি। আর্টিকেলটি সম্পূর্ণ পড়ে দেখার জন্য আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ। এমন তথ্যবহুল আর্টিকেল পাওয়ার জন্য আমাদের ওয়েবসাইটের সাথেই থাকুন।

আমি আসিফ আহমেদ। ২০২২ সাল থেকে আমি ব্লগিং নিয়ে চর্চা করছি। সকলের মাঝে জ্ঞানকে ছড়িয়ে দেয়ার অনুপ্রেরণা থেকে আর্টিকেল লেখা।

Leave a Comment