একটি জীবের জন্ম থেকে বেড়ে ওঠা পর্যন্ত পরিবেশের ভূমিকা মুখ্য। শুধুমাত্র পৃথিবী নয়, বিশ্ব ব্রহ্মাণ্ডের যে কয়েকটি গ্রহ রয়েছে তার প্রত্যেকটির নিজ নিজ পরিবেশ রয়েছে। এবং পৃথিবীর সম্পূর্ণ রূপের টিকে রয়েছে পরিবেশের উপর ভিত্তি করে। একটি নির্দিষ্ট স্থানের সবকিছুর অবস্থা এবং পরিস্থিতির সমষ্টিকে পরিবেশ বলা হয়ে থাকে। এই পৃথিবীতে যে সব জীব এবং অজিব বুক বসবাস করছে তারা প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষভাবে পরিবেশের মধ্যে সীমাবদ্ধ।
এই পৃথিবীর জলবায়ু থেকে শুরু করে সূর্যালোক পর্যন্ত প্রত্যেক টি জিনিস পরিবেশের অন্তর্ভুক্ত। এছাড়াও মহাবিশ্বের একমাত্র গ্রহ হলো পৃথিবী যেখানে জীবনের সন্ধান মিলে। মানব গোষ্ঠী বা জীবকুল নিয়ে আলোচনা করার জন্য প্রথমেই উঠে আসে পরিবেশের কথা। আজকের আর্টিকেলে আমরা পরিবেশ কাকে বলে? কত প্রকার ও কি কি এই নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করব।
পরিবেশ কাকে বলে
পরিবেশ হলো আমাদের চারপাশের সবকিছুর সম্মিলিত অবস্থা। পরিবেশের মধ্যে রয়েছে জীবন্ত জিনিস, যেমন মানুষ, প্রাণী এবং গাছপালা। এছাড়াও রয়েছে জড় পদার্থ, যেমন মাটি, পানি এবং বায়ু। আমাদের চারপাশে যা কিছু আছে, তা সবকিছু মিলেই তৈরি হয় পরিবেশ। পরিবেশ আমাদের জীবনযাত্রার উপর অনেক বড় প্রভাব ফেলে। আমরা যা খাই, যা পরি, যেখানে থাকি, সবকিছুই পরিবেশের অংশ। পরিবেশ ভালো থাকলে আমরা সুস্থ থাকি, সুন্দর থাকি।
পরিবেশের সংজ্ঞা
পরিবেশ খারাপ হলে আমাদের জীবনে অনেক সমস্যা হতে পারে। পরিবেশের সংজ্ঞা দিতে গিয়ে কয়েকজন বিজ্ঞানী বলেন:
বিজ্ঞানী মারকিউস এবং উডওয়ার্থ এর মতে- একটা জীবন শুরু হওয়ার পর ব্যক্তির ভেতরে এবং বাহিরে যা কিছু সক্রিয় অবস্থায় প্রবাহিত হয় তাই হলো পরিবেশ।
মনোবিজ্ঞানী বোরিং লংফিল্ড এবং ওয়েলড এর মতে- একজন ব্যক্তির ওপর তার জিনগত বৈশিষ্ট্য ব্যতীত অন্যান্য যেসব বৈশিষ্ট্যের প্রতিফলন ঘটে তাই হলো পরিবেশ।
বিজ্ঞানী মাসটন বেটস বলেছেন- জীবের জন্য পরিবেশ হলো বাহ্যিক অবস্থা সমষ্টি। পরিবেশ একটি জীবের বৃদ্ধি এবং সমৃদ্ধিকে প্রবাহিত হওয়ার জন্য কাজ করে থাকে।
পরিবেশ কত প্রকার ও কি কি
পরিবেশকে সাধারণত দুইটি প্রধান ভাগে ভাগ করা যায়। যথা:
- প্রাকৃতিক পরিবেশ,
- সামাজিক পরিবেশ।
১. প্রাকৃতিক পরিবেশ কাকে বলে
প্রাকৃতিক পরিবেশ হল সেই পরিবেশ যা প্রকৃতিগতভাবে বিদ্যমান এবং মানুষের তৈরি নয়। এই পরিবেশে উদ্ভিদ, প্রাণী, জল, মাটি, বায়ু এবং অন্যান্য প্রাকৃতিক উপাদান অন্তর্ভুক্ত। এটি আমাদের চারপাশের সেই জগৎ যা আমরা প্রাকৃতিকভাবে পেয়েছি এবং যা আমাদের জীবনযাত্রার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
২. সামাজিক পরিবেশ কাকে বলে
যে বিশেষ সমাজব্যবস্থার মধ্যে মানুষ বাস করে, তাকে সামাজিক পরিবেশ বলে। অন্যভাবে বলা যায়, মানুষের তৈরি করা পরিবেশই হলো সামাজিক পরিবেশ। মানুষ তার আশেপাশে যা কিছু তৈরি করেছে, যেমন – বাড়িঘর, রাস্তাঘাট, স্কুল-কলেজ, অফিস-আদালত, হাট-বাজার, শিল্প-কারখানা, ইত্যাদি সবকিছুই সামাজিক পরিবেশের অংশ। এছাড়াও, মানুষের বিভিন্ন কাজকর্ম, যেমন – চাষাবাদ, ব্যবসা-বাণিজ্য, চাকরি, শিল্প-সাহিত্য, ধর্ম, সংস্কৃতি, ইত্যাদিও সামাজিক পরিবেশের অন্তর্ভুক্ত।
পরিবেশের গুরুত্ব
পরিবেশ আমাদের চারপাশের ভৌত ও জৈব উপাদান নিয়ে গঠিত হয়ে থাকে। এই উপাদানগুলোর মধ্যে জটিল সম্পর্ক বিদ্যমান, যা আমাদের জীবন এবং পৃথিবীর পরিবেশের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। পরিবেশের গুরুত্ব আলোচনা করতে গেলে প্রথমে খাদ্য উৎপাদনের কথা বলতে হয়। আমরা যে খাবার খাই, তা মূলত পরিবেশ থেকেই আসে। মাটি থেকে ফসল উৎপন্ন হয়, যা আমাদের খাদ্য জোগায়। এছাড়া, পানি আমাদের জীবনধারণের জন্য অপরিহার্য। নিচে পরিবেশের গুরুত্ব বিস্তারিতভাবে তুলে ধরা হলো:
- পরিবেশ আমাদের আশ্রয় দেয়। মানুষ, জীবজন্তু, পাখি সবাই কোনো না কোনো পরিবেশে বাস করে। বন থেকে আমরা কাঠ সরবরাহ করে থাকি, যা আমাদের ঘরবাড়ি তৈরি এবং অন্যান্য কাজে লাগে।
- পরিবেশ আমাদের স্বাস্থ্যের উপর প্রত্যক্ষ ভূমিকা পালন করে। আমাদের আশেপাশের পরিবেশের অনেক গাছপালা ঔষধি গুণসম্পন্ন, যা আমাদের বিভিন্ন রোগ নিরাময়ে কাজে লাগে। এছাড়া, দূষণমুক্ত বায়ু এবং পানি আমাদের সুস্থ থাকতে সাহায্য করে।
- পৃথিবীতে যে জীবগুলো বসবাস করে তাদের জীবন নিয়ন্ত্রণের জন্য মুখ্য ভূমিকা পালন করে পরিবেশ।
- একটি সুস্থ পরিবেশ যুগের পর যুগ ধরে জলবায়ুর পরিবর্তন নিয়ন্ত্রণ এবং আবহাওয়া নিয়ন্ত্রণ করতে সহায়তা করে।
- প্রাণ ধারণের জন্য যেসব গুরুত্বপূর্ণ উপাদানগুলো দরকার তা সম্পূর্ণভাবে সরবরাহ করে পরিবেশ।
- বেঁচে থাকার জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উপাদান অক্সিজেন সরবরাহ করে থাকে পরিবেশ।
- পানি, জ্বালানি বা খনিজ উপাদান সবকিছুই সরবরাহ করে থাকে পরিবেশ।
- সর্বপরি প্রাকৃতিক ভারসাম্য বজায় রাখার জন্য পরিবেশ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
পরিবেশের একটি উপাদান নষ্ট হলে তার প্রভাব অন্য উপাদানগুলোর উপরও পড়ে। উদাহরণস্বরূপ, বন ধ্বংস করলে মাটি ক্ষয় হয়, যা কৃষি এবং পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর।
পরিবেশ দূষণ একটি বড় সমস্যা। বায়ু দূষণ, জল দূষণ এবং মাটি দূষণ আমাদের স্বাস্থ্য এবং পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর। এই দূষণ কমাতে আমাদের সচেতন হতে হবে এবং পরিবেশ বান্ধব প্রযুক্তি ব্যবহার করতে হবে। সর্বোপরি, পরিবেশ আমাদের জীবন এবং পৃথিবীর জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এর গুরুত্ব উপলব্ধি করে পরিবেশের যত্ন নেওয়া আমাদের সকলের দায়িত্ব।
পরিবেশের উপাদান কয়টি ও কি কি
পরিবেশের প্রধান উপাদানকে প্রধানত দুইটি ভাগে ভাগ করা হয়ে থাকে। যথা:
- জৈব উপাদান,
- জড় উপাদান।
১. জৈব উপাদান
জৈব উপাদানগুলির মধ্যে জীবন আছে এবং তারা নিজেদের খাদ্য তৈরি করতে বা পরিবেশের অন্যান্য উপাদানগুলির উপর নির্ভরশীল। উদাহরণস্বরূপ, উদ্ভিদ, প্রাণী, মানুষ এবং অন্যান্য জীবজন্তু।
২. জড় উপাদান
জড় উপাদানগুলির মধ্যে জীবন নেই, কিন্তু তারা পরিবেশের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। উদাহরণস্বরূপ, মাটি, জল, বায়ু, আলো, তাপমাত্রা ইত্যাদি।
এই দুইটি উপাদান একে অপরের সাথে সম্পর্কিত এবং একটি সুস্থ পরিবেশের জন্য উভয়েরই উপস্থিতি অপরিহার্য।
পরিবেশ সংরক্ষণের উপায় গুলো কি কি
বর্তমান বিশ্বে পরিবেশ সংরক্ষণ একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। আমাদের চারপাশের পরিবেশকে সুস্থ ও স্বাভাবিক রাখার জন্য এর গুরুত্ব অপরিহার্য। নিচে পরিবেশ সংরক্ষণের কিছু উপায় আলোচনা করা হলো:
১. বিদ্যুৎ সাশ্রয় করতে হবে
বিদ্যুৎ উৎপাদনে জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার হয়, যা পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর। তাই, প্রয়োজন না হলে লাইট বন্ধ রাখা, এনার্জি সেভিং বাল্ব ব্যবহার করা এবং অন্যান্য বিদ্যুৎ সরঞ্জাম ব্যবহার করার পর বন্ধ করে দেওয়ার মাধ্যমে বিদ্যুৎ সাশ্রয় করা যায়।
পানি সংরক্ষণ করা
পানি জীবনের জন্য অপরিহার্য। বৃষ্টির পানি সংরক্ষণ করে, পানির অপচয় কমিয়ে এবং পুকুর ও অন্যান্য জলাশয় ভরাট না করে পানি সংরক্ষণ করা যায়।
২. গাছ লাগানো
গাছপালা অক্সিজেন সরবরাহ করে এবং কার্বন ডাই অক্সাইড গ্রহণ করে পরিবেশকে সুস্থ রাখে। তাই, সবাই সবার আবাদ জমিতে যতটা সম্ভব গাছপালার রোপন করা জরুরী।
৩. দূষণ কমানো
বায়ু দূষণ, পানি দূষণ এবং মাটি দূষণ কমাতে পদক্ষেপ নেওয়া উচিত। ব্যক্তিগত গাড়ি ব্যবহার না করে গণপরিবহন ব্যবহার করা, কলকারখানার বর্জ্য পরিশোধন করে নদীতে ফেলা এবং প্লাস্টিকের ব্যবহার কমিয়ে দূষণ কমানো যায়।
৪. পণ্য রিসাইকেল করা
পুরনো জিনিসপত্র ফেলে না দিয়ে সেগুলোকে রিসাইকেল করে ব্যবহার করা যায়। এর মাধ্যমে নতুন করে জিনিস তৈরি করার জন্য প্রয়োজনীয় প্রাকৃতিক সম্পদ রক্ষা করা যায়।
৫. জৈব সার ব্যবহার করা
রাসায়নিক সারের পরিবর্তে জৈব সার ব্যবহার করে মাটি ও পরিবেশের স্বাস্থ্য রক্ষা করা যায়। এছাড়াও ফসলের ব্যবহার করলে তা মানব স্বাস্থ্যের জন্য অত্যন্ত উপযোগী।
৬. কীটনাশকের ব্যবহার কমানো
ফসলে কীটনাশকের ব্যবহার কমিয়ে পরিবেশের দূষণ কমানো যায় এবং স্বাস্থ্যকর এবং ভেজাল মুক্ত খাদ্য উৎপাদন করা যায়। ফসলের কীটনাশকের ব্যবহার জমি এবং মানুষ উভয়ের জন্যই ক্ষতিকর।
৭. বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ করা
বন্যপ্রাণী আমাদের প্রকৃতির ভারসাম্য রক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। তাই, তাদের আবাসস্থল রক্ষা করা এবং তাদের শিকার বন্ধ করা উচিত। বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ করলে প্রাকৃতিক পরিবেশ অধিকাংশে রক্ষা পায়
৮. পরিবেশ সম্পর্কে সচেতনতা বাড়ানো
পরিবেশ সংরক্ষণের গুরুত্ব সম্পর্কে জনগণকে সচেতন করা উচিত। এর জন্য বিভিন্ন প্রচার কর্মসূচি ও শিক্ষামূলক কার্যক্রম পরিচালনা করা যেতে পারে।
৯. সরকারি উদ্যোগ
পরিবেশ সংরক্ষণের জন্য সরকারের উচিত প্রয়োজনীয় আইন প্রণয়ন করা এবং তা কার্যকরভাবে প্রয়োগ করা। এক্ষেত্রে সরকারের পাশাপাশি জনগণের মুখ্য অবদান থাকা জরুরি।
পরিবেশ সম্পর্কিত কিছু প্রশ্নউত্তর
১)সামাজিক পরিবেশ কি কি উপাদান নিয়ে গঠিত?
উঃ সামাজিক পরিবেশ গঠিত হয় নিজ দেশের ভাষা, রীতিনীতি, ধর্মীয় দৃষ্টিভঙ্গি, মূল্যবোধ ও আচার-আচরণ দ্বারা।
২)প্রাকৃতিক পরিবেশের উপাদান কোনটি?
উঃ স্থলমন্ডল, জলমন্ডল, বায়ুমণ্ডল এবং জীবমণ্ডল প্রাকৃতিক পরিবেশের উপাদান।
৩)প্রকৃতি বলতে কী বোঝ?
উঃ প্রকৃতি শব্দের ইংরেজি প্রতিশব্দ হলো Nature। জাগতিক বিশ্বের যা কিছু আপনা আপনি তৈরি হয়েছে তাকেই প্রকৃতি বলে।
📌 আরো পড়ুন 👇
পরিবেশ নিয়ে আমাদের মতামত
মানুষের জীবনযাপনের জন্য যে সব গুরুত্বপূর্ণ উপাদান গুলো প্রয়োজন তা সবই আসে পরিবেশ থেকে। মানুষের জীবন যাপনে পরিবেশের ভূমিকা কোনভাবেই অস্বীকার করা যায় না। আজকের পোস্টে আমরা পরিবেশ কাকে বলে কত প্রকার ও কি কি তা নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করেছি। পরিবেশ সম্পর্কিত আর কোন প্রশ্ন থাকলে অবশ্যই আমাদেরকে কমেন্টের মাধ্যমে জানাবেন। এবং এমন তথ্যবহুল এডুকেশনাল আর্টিকেল পাওয়ার জন্য আমাদের ওয়েবসাইটে সাথেই থাকুন।